অজন্তা গুহা চিত্র
অজন্তাশৈলী ভারতে এবং অন্যত্র যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে জাভাতে। সংশ্লিষ্ট দুই মিনার গোষ্ঠীর সঙ্গে,ভারতীয় ইতিহাসের দুই গুরুত্বপূর্ণ সময় জড়িয়ে আছে। সামগ্রিক অজন্তা গুহা, ভারতীয় শিল্পবিবর্তনের ব্যতিক্রমী সাক্ষ্য বহন করে, সেইসাথে বৌদ্ধসম্প্রদায়ের ভূমিকা নির্ধারণ করে, বুদ্ধিজীবী ও ধর্মীয় প্রেক্ষাগৃহগুলো, ভারতে গুপ্ত এবং তাদের তাৎক্ষণিক উত্তরাধিকারীর বিদ্যালয়গুলো ও অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলো।২৯টি গুহা প্রায় ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে খনন শুরু করা হয়েছিল, কিন্তু তারা ইলোরার অণুকূলে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে পরিত্যক্ত হয়। পাঁচটি গুহাতে মন্দিরগুলো ছিল এবং চব্বিশটি গুহাতে মঠ ছিল যেগুলো প্রায় ২০০ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও শিল্পীদের দ্বারা অধিকৃত ছিল বলে মনে করা হয়। ১৮১৯ সালে একটি ব্রিটিশ বাঘশিকারের দল দ্বারা পুনরাবিষ্কৃত হবার আগে অবধি, অজন্তাগুহা ধীরে ধীরে বিস্মৃতিতে তলিয়ে গিয়েছিল।[৩]
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণলিপিতে অজন্তার বর্ণনা আছে। গুহাগুলো দীর্ঘকাল অরণ্যের আড়ালে বিস্মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। উনিশ শতকে, ১৮১৯ সালে, এগুলো নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। অজন্তা ও অদূরবর্তী ইলোরা ভারতের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র।
পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ থেকে ৫৫ মাইল দূরে অজন্তার বিস্তৃত ও বিস্ময়কর এই গুহামন্দিরচিত্র অবস্থিত। ঐতিহাসিকদের অনুমান খৃঃ পূঃ ৩০০ থেকে শুরু করে খৃঃ ৭০০ পর্যন্ত এই চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল। অর্থাৎ গুপ্ত যুগ এর শেষ পর্যন্ত এই গুহাচিত্র অঙ্কিত হয়েছিল। এই প্রকাণ্ড ভজনালয় (Chapels) এবং আশ্রমগৃহ (Monastic Hall) মূলত বুদ্ধের জীবনীর উপর অঙ্কিত দেওয়াল চিত্র (Murals Painting) সজ্জিত হয়েছিল। ভাস্কৰ্য্য ও স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই গুহায় পাওয়া যায়। তাই অজন্তা হল ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও দেওয়াল চিত্র এই তিন এর সঙ্গমস্থল।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রের পাশে অজন্তা গুহাচিত্রের স্থান আজও উচ্চাসনে এবং বিশ্বে সমাদৃত। দীর্ঘদিন অযত্নের ফলে এর অবস্থা জরাজীর্ণ। দীর্ঘ সময় ধরে অজন্তার গুহাগুলি খােদিত ও অঙ্কিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে প্রথম দিকে খােদিত ও পরবর্তীকালে বা শেষ শতকে চিত্র অঙ্কিত হয়। এই সময় সে সকল রাজারা রাজত্ব করেছিলেন তাহাদের অনুপ্রেরণায় কোন সময় চিত্র, কোন সময় ভাস্কৰ্য্য খােদিত হয়েছিল। মােট ২৯টি গুহার মধ্যে ১, ১৬, ১৭ নং গুহাগুলিসহ মােট ছটি গুহাতেই উল্লেখযােগ্য চিত্র ও ভাস্কর্য ছিল। গুহার দেওয়ালগুলিতে মানুষের শােভাযাত্রা, হাতির, রাজ সভাসদ ও ভিক্ষুদের চিত্রগুলি যেন সমান্তরাল শােভাযাত্রা রূপে অঙ্কিত হয়েছে। গুহার ছাদগুলি ফুল, ফল, পাখী ও দেবতাদের মূর্তিতে সযত্নে সজ্জিত করা হয়েছে। ইহা মানুষ ও প্রকৃতির মিলনের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত।
যদিও চিত্রগুলিতে কোন প্রকার আলােছায়ার প্রয়ােগ নাই। volume প্রকাশে মােটা মােটা রেখার প্রয়ােগ ঘটান হয়েছে। আবার কোন কোন ভাস্কর্যে পাথরের অবস্থানের মাধ্যমে পরিপ্রেক্ষিত এর অদ্ভুত প্রকাশ ঘটেছে। এর প্রভাব সুদূর বাহগুহা, ইলােরা, শিলং, আফগান, চীন, জাপান অর্থাৎ মধ্য এশিয়া পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়।
গুপ্ত যুগ থেকে ৭০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বেশীরভাব চিত্র ব্যাখ্যা জৈন সম্প্রদায় এর উদাহরণ। যদিও দেওয়াল চিত্র ও সাজসজ্জা সম্পর্কীয় ‘চৈত’ জন চিত্র (Flok Art) হিসাবেই পরিচিত ছিল (১৫০০ খৃষ্টাব্দে ফ্রান্স থেকে কাগজ আসবার পূর্ব পর্যন্ত)। | যদিও সেই সময় জৈন ভাস্কৰ্য্যগুলি ও দেবতা, ঘােড়া, প্রভৃতি চিত্রগুলি রেখা ও গাঢ় রং-এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র আকারে ও সমতলে চ্যাপটা (Flat) আকারে অঙ্কিত হত। দেহাবয়বগুলির কোনাকার বিন্যাস ও মুদ্রার অর্থপূর্ণ প্রয়ােগ রীতি সুরুচি সম্পন্ন (Symbolic) প্রতীক স্বরূপ। দীর্ঘ নয়ন, বাহু ও আঙ্গুলের সহজাত চাল সুন্দরভাবে রূপায়িত হয়েছে।
চিত্রগুলি হিন্দু ধর্মের রাজপুত চিত্রকলার সঙ্গে একটা যােগসূত্র খুজে পাওয়া যায়। রাজপুতানা অঞ্চল হল উত্তর পশ্চিম ভারতে শিল্পের পরিচালক। এই অঙ্কনশৈলী বহুদূর বিস্তৃতি লাভ করেছিল উত্তরে হিমালয়, পাঞ্জাব, পূৰ্ব্বে বুন্দেলখণ্ড দক্ষিণের কিছু অংশ, পশ্চিম দক্ষিণের গুজরাট ছাড়াও পাহাড়ী সমতলের বহু জায়গায়। তাই অজন্তা চিত্র স্থাপত্যের সাথে এর খুব মিল পাওয়া যায় এবং উভয় ক্ষেত্রেই তাই গােষ্ঠী বা সমবেত শিল্পীর কাজ পাওয়া যায়।
বৌদ্ধ শিল্পীরা তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন দেব, যক্ষ ও নাগা। দেব পদ্ধতি মহামানবের গুণ। যক্ষ পদ্ধতিতে ঐশ্বরিক শক্তিজনিত ও নাগা পদ্ধতিতে অমরাবতী আশ্চর্য এক গৌরবময় অধ্যায়।
অজন্তার চিত্রগুলি টেম্পারা পদ্ধতিতে অঙ্কিত। ৯ নং ও ১০ নং গুহাতে যে রং ব্যবহারে করা হয় তাহা ইণ্ডিয়ান রেড, গাঢ় বা কালচে সবুজ রং এছাড়াও সাদা, কালাে ও নীল রং এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। কিছু কিছু গুহায় নারী মূর্তিকে মাতা, পূজনীয়া, প্রেয়সী, নর্তকী বা দাসী রূপে ব্যবহারে প্রকাশ করা হয়, আর হলদেস হালকা বেগুনী ও লাল রং প্রভৃতি বর্ণে রঞ্জিত করা হয়েছে।
১ নং গুহায় পদ্মপানি বােধিসত্ত্ব মূর্তি, ১০ নং গুহার ষড়দন্ত জাতকের ছবি, ১৭ নং গুহার কৌতুকচিত্র ও বুদ্ধের সামনে মাতা পুত্রকে আশীর্বাদের চিত্রগুলি চিত্রনে বর্ণে অনবদ্য। উপরােক্ত ভাস্কৰ্য্য, চিত্র, রং ও অঙ্কন পদ্ধতি আলােচনার মাধ্যমে সহজেই অনুমান করা যায় যে অজন্তার চিত্র দীর্ঘ সময় ধরে রচনা কালে ও বহু শিল্পীর বা শিল্প গােষ্ঠির অঙ্কন শৈলী প্রয়ােগের জন্যই এই বিবর্তনগুলি ঘটেছিল।